♦স্লিপ প্যারালাইসিস/বোবা ধরা কি?
"স্লিপ প্যারালাইসিস/বোবায় ধরা"
স্লিপ প্যারালাইসিস শব্দটি অনেকেই প্রথমবার শুনলেও 'বোবা ধরা' শব্দটি শুনেন নি বা এই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাননি এরকম মনুষের সংখ্যা নিতান্তই কম অথবা নেই বললেও চলে। আপনি ঘুমিয়ে আছেন। হঠাৎ মাঝরাতে একটি বিকট শব্দে আপনার ঘুম ভেঙে গেল।আপনার বুকের ওপর ভারী কিছু বসে আছে বলে অনুভব করলেন। এতো ভারী যে ঠিকঠাক শ্বাসও নিতে পারছেন না। আপনি আপনার শরীর নাড়ানোর চেষ্টা করছেন সেটাও পারছেন না। পুরো শরীর নিস্তেজ হয়ে আছে। সাহায্যের জন্য চিৎকার করছেন কিন্তু মুখ থেকে আওয়াজ বের হচ্ছে না। কিছুক্ষণ স্থায়ী হওয়ার পর এই অনুভূতির রেশ কেটে গেলে আপনার মনে হবে এতক্ষণ যা হয়েছে তা কোন স্বপ্ন ছিলো না। তাহলে কি হল?এরকম অনুভব হওয়ার কারণ টাই বা কি!
চলুন একটু সময় নিয়ে জেনে আসি-
♦স্লিপ প্যারালাইসিস/বোবা ধরা কি?
এতক্ষণ যে পরিস্থিতির বর্ণনা দেখে আসলাম চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় এই সমস্যাকে বলা হয় স্লিপ প্যারালাইসিস বা ঘুমের মধ্যে পক্ষাঘাত, যাকে আমরা বোবায় ধরা বলে থাকি। স্লিপ প্যারালাইসিস হলে একজন ব্যক্তি কিছু সময়ের জন্য কথা বলা বা নাড়াচাড়া করার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। এটি সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থেকে এক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।তবে ওই সময়টাতে আক্রান্ত ব্যক্তি ভীষণ ঘাবড়ে যান, ভয় পেয়ে যান। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের স্নায়ু রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ সামান্থা আফরিনের মতে, স্লিপ প্যারালাইসিস বা বোবায় ধরা হলো গভীর ঘুম ও জাগরণের মাঝামাঝি একটি স্নায়ুজনিত সমস্যা। ঘুমের এই পর্যায়টিকে বলা হয় রেপিড আই মুভমেন্ট রেম। রেম হলো ঘুমের এমন একটি পর্যায় যখন মস্তিষ্ক খুব সক্রিয় থাকে এবং এই পর্যায়ে মানুষ স্বপ্ন দেখে। এ কারণে এ সময় মস্তিষ্ক সচল থাকলেও শরীরকে অসাড় মনে হয়।
♦কি হয় যখন স্লিপ প্যারালাইসিস ঘটে?
পেনিসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ব্রায়ান শার্পের মতে, স্লিপ প্যারালাইসিস বা বোবায় ধরার ক্ষেত্রে তিন ধরনের দৃষ্টিভ্রম বা হ্যালুসিনেশন তৈরি হতে পারে।
★প্রথমটি ইনট্রুডো বা ঘরের ভেতর কোনো অতিপ্রাকৃত কিছুর উপস্থিতি টের পাওয়া।
★দ্বিতীয়টি ইনকিউবিস। আপনার মনে হতে পারে যে, কোন দৃশ্যমান বা ইষৎ অদৃশ্য সত্তা আপনার বুকের ওপর চেপে বসে আছে।
★সর্বশেষ লেভিটেশন। আপনার মনে হতে পারে, আপনাকে কেউ শোয়া অবস্থাতেই শূন্যে তুলে ফেলেছে এবং কোনো অচেনা গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
♣চলুন এবার জেনে নেই স্লিপ প্যারালাইসিসকে বিজ্ঞানীরা কিভাবে ব্যাখ্যা করছেন।
♦বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাঃ
★কেন শরীরকে নাড়ানো যায় না?
মানুষ যখন ঘুম আর জাগ্রত অবস্থার মাঝামাঝি পর্যায়ে অবস্থান করে এবং সেসময় স্বপ্ন দেখা থেকে নিজেকে দূরে সরাতে চায় তখনই মানুষের ঘুম ভেঙে যায়। মানুষ তখন শরীরকে নড়াচড়া করার জন্য ছটফট করতে থাকে। যারা স্বাভাবিক থাকেন তারা নড়াচড়া করতে পারেন কিন্তু যাদের মলিকিউলার ক্লকে বা ঘড়িতে অকার্যকারিতা থাকে তাদের সেসময় স্লিপ প্যারালাইসিস হয়ে থাকে। অর্থ্যাৎ জেগে ওঠার পরও সেসব মানুষ তার ঘুমন্ত অবস্থায় থেকে যায়। এ পর্যায়টি কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
★ছায়াটি আসলে কি?
গবেষকদের মতে মস্তিষ্কে নিজের সঙ্গে কথোপকথনই ওই ছায়ারূপে হাজির হয়। তাদের মতে, মস্তিষ্কের নিউরন গুলো শরীরের অঙ্গপ্রতঙ্গকে নড়াচড়া করতে বলে। কিন্তু শরীর যখন নিউরনের সেই নির্দেশ মানতে পারে না তখন ওই ছায়ার অনুভূতি হয়। আবার কোন কোন গবেষকের মতে, মানুষের মস্তিষ্কে অ্যামিগডালা নামে আতঙ্ক তৈরিকারী যে অংশটি থাকে তার অতিরিক্ত সক্রিয়তার কারণে এ ধরনের ছায়া দেখা যেতে পারে। তাদের মতে ঘুমের মধ্যে মানুষের অ্যামিগডালা যখন অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে তখন মানুষ আতঙ্কিত হয়ে জেগে যায়। মস্তিষ্ক তখন এ আতঙ্কের কারণ নির্ধারন করার চেষ্টা করে আর সে সময় ছায়া অনুভূত হতে পারে।
★ উড়ে বেড়ানোর অনুভূতি হয় কেন?
গবেষকদের মতে, ব্রেণস্টেম এবং কর্টিক্যাল ভেস্টিবুলারের সক্রিয়তার কারণে এ ধরনের অনুভূতি হতে পারে।
♦সাধারণ লক্ষণসমূহঃ
ডাঃ সামান্থা আফরিনের মতে এবং ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী স্লিপ প্যারালাইসিসের সাধারণ কয়েকটি লক্ষণ রয়েছে। সেগুলো হলো:
১. বড় করে শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া। মনে হবে যেন বুকের মধ্যে কিছু চাপ দিয়ে আছে।দম বেরোচ্ছেনা।
২. অনেকের চোখ খুলতে এমনকি চোখ নাড়াচাড়া করতেও সমস্যা হয়।
৩. অনেকের মনে হয় যে, কোন ব্যক্তি বা বস্তু তাদের আশেপাশে আছে, যারা তার বড় ধরনের ক্ষতি করতে চায়।
৪. ভীষণ ভয় হয়, শরীর ঘেমে যায়।
৫. হৃৎস্পন্দন ও শ্বাসপ্রশ্বাস এর গতি বেড়ে যায়। অনেকের রক্তচাপও বাড়তে পারে
৬. পুরো বিষয়টি কয়েক সেকেন্ড থেকে এক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। প্রভাবটি কেটে গেলে আগেএ মতো কথা বলা বা নাড়াচাড়া করার কোন সমস্যা থাকে না। তারপরও অনেকে অস্থির বোধ করেন এবং পুনরায় ঘুমাতে যেতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
♣স্লিপ প্যারালাইসিস কাদের হয়?
স্লিপ প্যারালাইসিস হওয়ার নির্দিষ্ট কোন বয়স নেই। এই পরিস্থিতি যে কারও সঙ্গে যেকোন বয়সে হতে পারে। তবে ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা বা এনএইএস এর তথ্য মতে তরুণ-তরুণী এবং কিশোর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
স্লিপ প্যারালাইসিস এর কারণঃ
স্লিপ প্যারালাইসিস হওয়ার পেছনে কিছু কারণ কে চিহ্নিত করা হয়-
১. পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব বা ছেড়ে ছেড়ে ঘুম হওয়া।
২. অসময়ে ঘুমোনো, অনেক সময় কাজের সময় নির্দিষ্ট না হলে অথবা দূরে কোথাও ভ্রমণে গেলে এমন সমস্যা হতে পারে।
৩. পরিবারে কারো স্লিপ প্যারালাইসিস হয়ে থাকলে।
৪. সোশ্যাল অ্যানজাইটি বা প্যানিক ডিসঅর্ডার বা বাইপোলার ডিসঅর্ডারের মত মানসিক সমস্যা থাকলে।
৫. অস্থিরতাও স্লিপ ডিজঅর্ডারের একটি কারণ।
৬. সোশ্যাল অ্যাঙ্কজাইটি ব প্যানিক ডিসঅর্ডার অথবা বাইপোলার ডিজঅর্ডার এর মতো মানসিক সমস্যা থাকলে।
৭. কর্মক্ষমতা বাড়ানোর ঔষধ ব্যাবহার।
স্লিপ প্যারালাইসিস কি ক্ষতিকর?
স্লিপ প্যারালাইসিস ক্ষতিকর নয় কিন্তু অনেকেই এই অনুভূতি সম্পর্কে খুবই ভয়ে থাকেন, কারণ তারা জানেন না ওই সময়ে কি ঘটছে, কেন ঘটছে এবং ওই মুহূর্তে ঠিক কি করা উচিত। যদিও কিছু সময় পর এই অনুভূতির রেশ কেটে যায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
চিকিৎসাঃ
স্লিপ প্যারালাইসিস আসলে গুরুতর কোনো রোগ নয়। মাঝে মাঝে নিজে থেকেই ভালো হয়ে যায়। মনকে চাপমুক্ত রাখার পাশাপাশি ঘুমানোর অভ্যাসে ও পরিবেশে ইতিবাচক পরিবর্তন আনলে অনেক ক্ষেত্রেই এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা সাধারণ কিছু পরামর্শ দিয়েছেনঃ
১. রাতে অন্তত ৬ ঘন্টা থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করা এবং সেই ঘুম যেন গভীর হয়।
২. প্রতিদিন রাতে একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং সকালে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠার অভ্যাস করা। এমনকি ছুটির দিনগুলোতেও।
৩. ঘুমের জন্য শোবার ঘরটিতে আরামদায়ক পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করতে হবে। যেন সেই ঘরে কোলাহল না থাকে, তাপমাত্রা সহনীয় মাত্রায় থাকে, খুব বেশি না আবার কমও না। সম্ভব হলে ঘরে ল্যাভেন্ডারের সুগন্ধি ছিটিয়ে দেয়া যেতে পারে।
৪. ঘুমানোর পদ্ধতি পাল্টান বিশেষত উপুর হয়ে কখনোই ঘুমাবেন না ।
৫. ঘুমাতে যাওয়ার আগ মুহূর্তে ভারী খাবার, সেই সঙ্গে ধূমপান, মদপান এবং ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়, যেমন: চা-কফি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৬. ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত ৪ ঘন্টা আগে ব্যায়াম করার চেষ্টা করা।
৭. দিনের বেলা দীর্ঘ সময় ঘুম থেকে বিরত থাকতে হবে।
৮. প্যারালাইসিস হলে নিজের মনকে বোঝাতে হবে যে ভয়ের কিছু নেই, এই পরিস্থিতি সাময়িক, কিছুক্ষণ পর এমনিতেই এসব ঠিক হয়ে যাবে। এই সময়ে শরীর নড়াচড়া করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হবে।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে?
এসব নিয়ম মেনে চলার পরও যদি কারো বাড়াবাড়ি রকমের স্লিপ প্যারালাইসিস হয় তাহলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
কেননা স্লিপ প্যারালাইসিস ঘনঘন হলে উদ্বিগ্নতার কারণে রক্তচাপ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে বা কমে যায়, যা বড় ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকির সৃষ্টি করতে পারে।
চিকিৎসক রোগীর সার্বিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন।
No comments